রেল ভ্রমণে নারী যাত্রীদের ধর্ষিত হওয়ার ভয়

চলন্ত ট্রেনে নারীদের ধর্ষণে পিছিয়ে নেই রেল কর্মচারীরাও

Passenger Voice    |    ০৬:৫৪ পিএম, ২০২৪-০১-১৮


চলন্ত ট্রেনে নারীদের ধর্ষণে পিছিয়ে নেই রেল কর্মচারীরাও

জয়নাল আবেদীনঃ যাতায়াতে নিরাপদ বাহন হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ রেলওয়ে। কম খরচে স্বাচ্ছন্দে ভ্রমণ করা যায় রেলে।  তবে দিন দিন এই রেল যেন নারী যাত্রীদের জন্য আতঙ্কের বিষয় হয়ে যাচ্ছে। একা ভ্রমনে ভয় পাচ্ছে কিশোরী থেকে বিবাহিত নারীরাও। ২০১৯ সাল থেকে রেলে ভ্রমণ করতে গিয়ে বেশ কিছু নারীকে হতে হয়েছে ধর্ষণের শিকার। তবে দায়ীদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোন শাস্তির ব্যবস্থা না থাকায় রেল কর্মীরাও এই অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে। 

সূত্র বলছে, রেলের পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলে কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি লোমহর্ষক ধর্ষনের শিকার হয়েছে শিশু থেকে বিভিন্ন বয়সের নারীরাও। চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারী (মঙ্গলবার) রাতে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা লালমনিরহাট-ঢাকা রুটে চলাচলকারী আন্তঃনগর ট্রেন লালমনি এক্সপ্রেস ট্রেনটি জয়দেবপুর স্টেশনে এলে ১৩ বছর বয়সী শারীরিক প্রতিবন্ধী এক কিশোরী ভুল করে ওই ট্রেনে চড়ে। চেকিংয়ের সময় তার কাছে টিকিট না পাওয়ায় অ্যাটেন্ডেন্ট আক্কাস আলী মেয়েটিকে তার কক্ষে নিয়ে যান। পরে একটি ফাঁকা কেবিনে নিয়ে মেয়েটিকে ধর্ষণ করেন ওই অ্যাটেন্ডেন্ট।' পরে মেয়েটির চিৎকারে ট্রেনের যাত্রীরা কেবিন থেকে মেয়েটিকে উদ্ধার করে এবং অ্যাটেন্ডেন্টকে পিটুনি দিয়ে পুলিশের কাছে সোপর্দ করেন। চলন্ত ট্রেনে ধর্ষণের ঘটনা এই প্রথম নই। যেখানে ট্রেনে যাত্রাকে নিরাপদ হিসেবে বিবেচনা করা হতো সেখানে এমন স্পর্শকাতর ঘটনা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন গণপরিবহন বিশেষজ্ঞরা। এতে করে চলন্ত ট্রেনে নারীদের যাত্রা দিন দিন অনিরাপদ হয়ে ওঠেছে। এসব ঘটনার দায়দায়িত্ব বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষও এড়াতে পারেন না বলে মনে করছেন রেল সংশ্লিষ্টরা।

রেলওয়ে ও বাংলাদেশ পুলিশের বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় এর আগেও ২০২০ সালের ২০ জানুয়ারী রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশন মাষ্টার মঈন উদ্দীন ধর্ষণ করেছিল দুই সন্তানের জননী এক গৃহবধুকে। সেই সময়ে রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মিহির কান্তি গুহ গণমাধ্যমকে বলেছিলেন এই ধর্ষকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছে। একই ভাবে গত মঙ্গলবারের ঘটনায় পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের লালমনিরহাট রেলওয়ের বিভাগীয় ম্যানেজার আব্দুস সালামও গণমাধ্যমকে জানান, অ্যাটেন্ডেন্ট আক্কাস আলীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। 

পশ্চিমাঞ্চলের রেলে কেন এত ধর্ষণ এই বিষয়ে জানতে চাইলে রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক অসিম তালুকদার প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে বলেন, রেলওয়ে কর্মকর্তা/কর্মচারীরা যদি ট্রেনে অথবা স্টেশনে কোন নারীযাত্রীকে ধর্ষন করে বা শীলতাহানির চেষ্টা করে তাহলে তাদের শাস্তিদেয়ার বিধান রয়েছে আদালতের। আমরা শুধু তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে পারি। চলন্ত ট্রেনে যে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে সেটা দেখভাল করবে রেলওয়ে পুলিশ। আমরা এমন ঘটনায় তদন্ত করে শুধু চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করতে পারি।  এরপর আদালত তাদের যে শাস্তি দেয় সেটায় হয়, আদালতের বাহিরে আমরা কিছুই করতে পারিনা। কারণ কোর্ট শাস্তি দিলে আমাদের দ্বিতীয়বার বিচার করার এখতিয়ার নেই। এছাড়া লালমনি এক্সপ্রেসে ধর্ষনের বিষয়ে তিনি আরো বলেন, ব্যক্তি বিশেষের দায়িত্ব আমরা নিবোনা। সে অত্যন্ত ঘৃণিত কাজ করেছে। তার দায়ভার রেলওয়ে নিবেনা। রেলের যে নিয়মনীতি আছে সে অনুসারে আমরা ব্যবস্থা নিবো।

এর আগে ২০১৯ সালের ২১ আগষ্ট ঢাকা রেলওয়ে স্টেশন (কমলাপুর) একটি ট্রেনের পরিত্যাক্ত বগির টয়লেটের ভেতর থেকে মাদ্রাসা ছাত্রী আসমার লাশ উদ্ধার করা হয়েছিলো। আসমা আক্তারকে ধর্ষনের পর শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছিল দূর্বৃত্তরা। ২০১৯ সালে ২২ জুন সিরাজগঞ্জের শহীদ ক্যাপ্টেন মনসুর আলী রেলওয়ে স্টেশন থেকে রাজশাহীতে যাওয়ার পথে আন্তঃনগর সিল্কসিটি এক্সপ্রেস ট্রেনের টয়লেটে অষ্টম শ্রেণীর এক ছাত্রীকে মোঃ মমিনুল ইসলাম (২৬) নামের এক যুবক ধর্ষনের চেষ্টা করে। 

২০২০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি নাটোরে চলন্ত ট্রেন থেকে নামিয়ে নিলিমা আকতার নামের এক নারীকে ধর্ষনের চেষ্টা করে সাবেক স্বামী জালাল উদ্দিন।

এরপর ২০২১ সালের ৩০ জানুয়ারী সিলেট স্টেশন থেকে ছেড়ে আসা সুরমা মেইল ট্রেনে ট্রেনের সহকারী জেনারেটর অপারেটর জাহিদ চলন্ত ট্রেনে ১৮ বছর বয়সের এক তরুণীকে ধর্ষণ করেন। অন্যদিকে ২০২২ সালের ২৮ জুন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শাটল ট্রেনে এক ছাত্রীকে শারীরিকভাবে হেনস্থা করেছিল বাবুল হোসেন নামের এক ব্যক্তি। সর্বশেষ ২০২৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর এক ব্যক্তি নিজের সৎমেয়েকে ধর্ষণ করে এবং ধর্ষণের কথা গোপন রাখতেই শ্বাসরোধে হত্যা করে মেয়েকে চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে দেয়। 

নারী যাত্রীরা নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন যাতায়াতের জন্য রেলকে বেশি প্রাধান্য দিলেও বেশ কিছু অপ্রিতিকর ঘটনায় তারা ঝুঁকি মনে করেন। ট্রেনের কর্মচারীদের হাতে নারী যাত্রী ধর্ষণ আরো বেশি আতঙ্কিত করছে তরুনীদের।  তবে রেল কর্তৃপক্ষ নারী যাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয়ে স্পেশাল কোন পদক্ষেপ নেয়নি। আর ট্রেনের টয়লেটে এসব ধর্ষনের ঘটনা বেশি ঘটে। বছর পেরোতেই ট্রেনে রেলওয়ে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ধর্ষনের শিকার হয়েছেন ভুক্তভোগী নারীরা। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের গাফিলতি ও পেশাদারিত্ব না থাকায় মেইল, কমিউটার ও লোকাল ট্রেনে শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধারাও যৌন হয়রানীর শিকার হচ্ছেন। অনেক নারী মান সম্মানের ভয়ে যৌন হয়রানীর বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেন। এতকিছুর পরও নারী যাত্রীদের নিরাপত্তায় কর্তৃপক্ষের টনক নড়ছেনা।